রাজা গোলাম রাব্বানীঃ সম্প্রতি বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়েছে। এই নিষিদ্ধকরণ নিয়ে যেমন একদল মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করেছে, তেমনি অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, “আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা উচিত হয়নি।” এই লেখায় আমি বিশ্লেষণ করার চেস্ট করব এই নিষিদ্ধকরণ কতটা যৌক্তিক ছিল, এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিস্ট দলের প্রতি কী ধরনের আচরণ করা হয়।
একটি প্রবাদ আছে “বৃক্ষ তোমার নাম কি, ফলে পরিচয়” তেমনি একটি দলের নাম নয়, সেই দলের আচরণই হইবে আসল বিষয়। রাজনীতি হলো বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আচরণের সমষ্টি। যখন একটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে, বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করে, সাংবাদিক ও বিরোধী নেতাদের দমন করে এবং ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার দিকে ধাবিত হয়, তখন সেই দলটিকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না।
আওয়ামী লীগ বিগত এক যুগে ঠিক এই কাজগুলোই করেছে, যেমন, একতরফা নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪), বিরোধীদের কারাবন্দি ও গুম, সংবাদমাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতির চক্র, ব্যাংক লুট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার। এই কর্মকাণ্ডগুলো কোনো গণতান্ত্রিক দলের নয় বরং এগুলো ফ্যাসিবাদের চিহ্ন।
অনেকে মনে করেন, কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা অনিয়মতান্ত্রিক কিন্তু ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা, আমরা যদি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দল নিষিদ্ধকরণ ঘটনাবলী দেখি তাহলে সেখানে জার্মানির নাৎসি পার্টিকে (Nazi Party) ১৯৪৫ সালে নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ তারা গণতন্ত্র ধ্বংস করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিল।ইতালির মুসোলিনির নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট পার্টিকে (Fascist Party) ১৯৪৩ সালে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।গ্রীসে ২০২০ সালে গ্রিসের আদালত চরম দক্ষিণপন্থী ‘Golden Dawn’ দলকে অপরাধী সংগঠন বলে ঘোষণা করে নিষিদ্ধ করে।
আমরা আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রূপ যদি দেখি তাহলে সেখানে দেখবো নেতৃত্বের পূজা, শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনা” বলেই তারা দলের বাইরে কাউকে কল্পনা করত না। ভয়ভীতি ও দমন ও রাজপথে বিরোধী নেতাদের গুলি, হামলা, মামলা নিত্যদিনের ঘটনা ছিল।প্রশাসন দখল থেকে শুরু করে পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা সবকিছু দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে।নির্বাচনহীনতাকে একটি স্বাভাবিক ঘটনা বানিয়ে ফেলেছিল, মানুষের ভোটাধিকারকে কেবল সাংবিধানিক নিয়মে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবতায় ছিল না। এই আচরণগুলোর কারণে আওয়ামী লীগ আদতে একটি গণতান্ত্রিক দল নয়—বরং একটি ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন আসে নিষিদ্ধকরণ কি সমস্যার সমাধান করতে পারে? কোনো রাজনৈতিক দলের নিষিদ্ধকরণ কখনোই প্রথম সমাধান নয়, কিন্তু যখন তারা গণতন্ত্র ধ্বংস করে রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করে নেয়, তখন নিষিদ্ধকরণ হয়ে ওঠে রাষ্ট্র রক্ষার শেষ অস্ত্র। সুতরাং, আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণকে কেউ যেন “রাজনৈতিক প্রতিশোধ” মনে না করেন, এটি গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারের পক্ষে নেওয়া একটি রক্ষণাত্মক পদক্ষেপ।
আমি মনে করি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা মানে শুধু একটি রাজনৈতিক দলকে থামানো নয় বরং এটি একটি বার্তা, বাংলাদেশ আর কোনো একদলীয় শাসন মেনে নেবে না। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে ক্ষমতা হবে জনগণের, নির্বাচনে প্রতিযোগিতা থাকবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো জনস্বার্থে কাজ করবে। ফ্যাসিবাদ যে নামেই আসুক না কেন, বাংলাদেশে তার কোনো ঠাঁই নেই।