এ প্রশ্নটি আমার মনে গভীরভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশ্লেষণ করে দেখলে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগ চাইলে বহু আগেই জামায়াতকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দিতে পারত। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে তারা দলটিকে টিকিয়ে রেখেছে। কেন?
কারণ, জামায়াতকে একেবারে নিষিদ্ধ করলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হতো তারাই, যারা আদর্শিকভাবে জামায়াতকে অনুসরণ ও সমর্থন করে। তারা ৭১-এর গ্লানি থেকে বের হয়ে নতুন নেতৃত্বে একটি পরিচ্ছন্ন, বড় দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত দ্রুততম সময়ে। আওয়ামী লীগ সেটা হতে দিতে চায়নি। তারা চেয়েছে, জামায়াতপন্থিরা একটা ছাতার নিচে থাকুক—তাদের টার্গেট করা সহজ হোক, যাতে রাজনৈতিকভাবে অপমান-অবমূল্যয়ন করা যায়।
ফলে দেখা গেছে, জামায়াত টিকে আছে, কিন্তু গ্রহণযোগ্য ও গণমানুষের দল হিসেবে রাজনৈতিকভাবে এগোতে পারেনি। ইতিহাসের দায় আর আত্মবিশ্বাসের সংকটে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ছোট করে রেখেছে। এই গেমে আওয়ামী লীগ স্বল্পমেয়াদে রাজনৈতিক সুবিধা পেলেও, দীর্ঘমেয়াদে দেশের রাজনীতিতে নৈতিকতা ও গঠনমূলক সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। মহান স্বাধীনতা নিয়ে জাতীয় বিভক্তির অবসান হয়নি। ২০২৪ এর গন-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেরাও ব্যাপকভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, আর জামায়াত বলয় আজও ৭১-এর গ্লানির বেড়াজালে বন্দি।আওয়ামী লীগকে কীভাবে দেখা উচিত?আওয়ামী লীগ কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়—এটি একটি আদর্শিক বলয় যা একটা ধর্ম বা এথনিসিটির মত, যার মূল নীতিমালা হল:▪️গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার হরণ।
▪️গুম, খুন ও গনহত্যা সহজিকরণ।▪️রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণ।▪️দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে ‘সেফ জোন’ তৈরি।▪️ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতি এবং তাবেদারি করা।এই দলটি এখন এমন একটি অবস্থানে, যেখান থেকে তাদের কার্যক্রম জাতির সঙ্গে একধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। ফলে, তাদেরও জামায়াতের মতো একটি “সনাক্তযোগ্য কর্নারে” রেখে রাজনৈতিক খেলায় ব্যবহার করা সম্ভব।তাহলে কোনটা ভালো? জামায়াতের মতো কোণঠাসা করে রাখা, না কি সরাসরি নিষিদ্ধ করা?আমার মতে, আওয়ামী লীগকে সরাসরি নিষিদ্ধ করা হলে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ উপকৃত হবে।▪️একটি পরিচ্ছন্ন রাজনীতি শুরু হবে।▪️বিভাজন কমবে, জাতীয় ঐক্য তৈরি হবে।▪️আওয়ামী আদর্শের মধ্যে যারা ইতিবাচক, তাদের জন্য নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি হবে।▪️তারা আর গুম, খুন, লুটপাটের দায় বইবেন না, যেমনটা জামায়াত বহন করে চলেছে।▪️রাজনীতিতে সেবা ও নৈতিকতার প্রতিযোগিতা চলবে। তুলনামূলক কারা বেশি ভালো, কে বেশি বাংলাদেশ পন্থী এমন প্রতিযোগিতা তৈরি হবে।
অনেকেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছেন—পুরনো দল, উন্নয়নমুখী অন্য বড় দলের চেয়ে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, শেখ মুজিবের উত্তরসূরি ইত্যাদি কারণে। কিন্তু এসব ইতিবাচক ইমেজ এখন অনেকটাই মলিন হয়ে গেছে। গণতন্ত্রহীনতা, গুম, খুন, লুটপাট ও দুর্নীতির দায়ে দলটি জনগণের আস্থাভাজন নয়।
সুতরাং, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে—আওয়ামী লীগপন্থী ইতিবাচক চিন্তাধারার মানুষরা নতুনভাবে রাজনীতিতে আসার সুযোগ পাবেন। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্বৃত্তায়ন ও দমননীতি থেকে রাজনীতি মুক্ত হবে। যারা খুন ও গুমের দায়ে অভিযুক্ত, তারা বিচারের মুখোমুখি হবেন। দেশে একটি টেকসই, মানবিক, ইনসাফভিত্তিক রাজনীতি বিকশিত হবে
এটা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, পুরো বাংলাদেশের জন্য এক নতুন রাজনৈতিক সূচনার পথ হতে পারে। তাহলে কীভাবে হতে পারে আওয়ামী লীগের রিকনসিলিয়েশন বা ইতিবাচক পরিণতি? আমার দৃষ্টিতে, আওয়ামী লীগের পুনর্মূল্যায়ন বা রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়া হতে পারে দুই ধাপে—একদিকে জবাবদিহিতা, অন্যদিকে নতুন সুযোগ। প্রথমত, যারা গুম, লুটপাট, গণহত্যা বা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত—তাদের চ্যাপ্টার চিরতরে ক্লোজ করতে হবে। বিচারিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হয়ে তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ইতিহাসে আরেকটি জামায়াত তৈরি না করে, এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি এখানেই থামাতে হবে।অন্যদিকে, যারা এই অপরাধগুলোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন, কিন্তু আদর্শ বা চেতনায় আওয়ামী লীগের অনুগামী ছিলেন—২০২৪ এর পরাজয়ের পর তারা হতাশ, অনুতপ্ত এবং আত্মসমালোচনায় প্রস্তুত—তাদের জন্য একটা নতুন সুযোগ থাকা উচিত। যেহেতু বাংলাদেশটা সবার, সবাই এদেশের নাগরিক। নাগরিক হিসেবে দেশে বসবাস ও রাজনীতি করার নাগরিক অধিকার আছে যদি সে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দেশদ্রোহিতার সাথে জড়িত না থাকেন।
এই মানুষগুলো যদি অনুশোচনা ও আত্মবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে নিজেদের অবস্থান পর্যালোচনা করেন, এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো গুম, খুন বা লুটপাটের অভিযোগ না থাকে—তাহলে তারা দুইটি পথ বেছে নিতে পারেন: ১. পছন্দসই অন্য গণতান্ত্রিক, বাংলাদেশপন্থী দলে যোগ দেওয়া ২. নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ বা সংগঠন গড়ে তোলা
এই রকম একটি রিকনসিলিয়েশন প্রসেস কেবল আওয়ামী লীগের জন্য নয়—সব মত, পথ ও মতাদর্শের মানুষের জন্যও ইতিবাচক বার্তা দিতে পারে। এতে দেশের রাজনীতিতে একটি নৈতিক পুনর্জাগরণ ঘটবে এবং দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ একটি আরও মানবিক, ইনসাফভিত্তিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক,
বোরহান উদ্দীন রাব্বানী,
তথ্য ও গবেষণা সহ-সম্পাদক, আমার বাংলাদেশ পার্টি।
এমএসসি ইঞ্জিনিয়ার, ইউনিভার্সিটি মালায়া।