রাজা গোলাম রাব্বানীঃ “যারা অতীত ভুলে সামনে হাঁটে, ভবিষ্যতের ওপর তাদের কোনও অধিকার থাকে না।” – এই প্রবাদটি আজকের বাংলাদেশ রাজনীতিতে বিএনপির সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। ইতিপূর্বে ৯০ এর অভ্যুত্থানের পর বিএনপি দুই দফা রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে দেশ পরিচালনা করেছে ১৯৯১-১৯৯৬ ও ২০০১-২০০৬।এই সময়গুলোতে: গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা (১৯৯১) বিএনপির বড় অবদান ছিল। একই সাথে দলীয়করণ, প্রশাসনিক পক্ষপাত, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ও দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগও জোরালোভাবে উঠে আসে, বিশেষ করে দ্বিতীয় মেয়াদে।তার পর থেকে নেতৃত্বের কেন্দ্রীকরণ, দুর্নীতিগ্রস্ত চক্রের প্রভাব ও আইডিওলজিক্যাল দিক থেকে একধরনের অস্পষ্টতা যা বিএনপির প্রতি জনগনের আস্থার অনেক বড় ক্ষতি করেছে।
২০২৪ সালে দেশে যে বিপ্লব প গণজাগরণ এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা বিএনপি-জামায়াত কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নিছক একটি রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। এটি ছিল গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। বিএনপি এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে নতুন সুযোগ পেয়েছে নিজেকে নতুনরূপে উপস্থাপন করার একটি আদর্শভিত্তিক, দায়বদ্ধ ও ভবিষ্যতমুখী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি পারবে আদর্শিক শুদ্ধিকরণ করতে? অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে? রাজনীতিকে পরিবারকেন্দ্রিকতা থেকে সরিয়ে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক করতে? কিংবা তরুণ নেতৃত্ব ও প্রযুক্তিনির্ভর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে?
জনগণ আসলে কি চায় সেটা যদি বিএনপির নেতৃবৃন্দ বুঝতে না পারে তাহলে আবারো বাংলাদেশে সেই পুরানো স্বৈরতন্ত্র বাসা বাধবে সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। জনগণ চায় একটি নতুন বাংলাদেশ। বর্তমান বাংলাদেশের বেশীর ভাগ মানুষ ও তরুণ সমাজ, শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে অধিক সচেতন। তারা মোটা দাগে চায় আইনের শাসন, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, মুক্ত গণমাধ্যম, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা। বিএনপি যদি বাংলাদেশের সত্যিকারের নেতৃত্ব দিতে চায়, তাহলে তাদের শুধু আন্দোলন নয়, ভিশন দিতে হবে, দিতে হবে একটি স্পষ্ট নাগরিক অধিকারভিত্তিক, ইনক্লুসিভ ও আধুনিক রাষ্ট্রের রূপরেখা।
আর একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো, ভারতীয় আধিপত্য থেকে মুক্ত একটি নতুন বাংলাদেশ “স্বাধীনতা মানে শুধু পতাকা নয় — স্বাধীনতা মানে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অধিকার।” এই কথাটির বাস্তব প্রয়োগ নিয়েই আজ বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে গভীর এক প্রশ্ন জেগেছে: আমরা কি সত্যিই স্বাধীন, নাকি ‘নির্ভরশীল’? ২৪-এর বিপ্লব ছিল ভারতীয় আধিপত্যবিরোধী চেতনার বিস্ফোরণ, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গণজাগরণ নিছক নির্বাচন-সংক্রান্ত ছিল না। এটি ছিল একটি বিদেশ-নির্ভর শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের ঘৃণা, ভারতীয় প্রভাব, দখলবাদ ও একতরফা সম্পর্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করে একটি সার্বভৌম সিদ্ধান্ত-নির্ভর বাংলাদেশ গড়ার স্পৃহা। আজ বাংলাদেশের ৯০% জনগণ বিশ্বাস করে, ভারতের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত হস্তক্ষেপ, বাজার দখল, নদী ও সীমান্ত প্রশ্নে ঔপনিবেশিক আচরণ বন্ধ না হলে প্রকৃত স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ থাকবে।
বিএনপি বাংলাদেশের একমাত্র প্রধান রাজনৈতিক দল, যার ইতিহাসে ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্পষ্ট নীতি রয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, তারা কি এখন সেই চেতনায় সত্যিকারের নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত? যদি সত্যি বিএনপি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রস্তুত থাকে তাহলে ভারত-নির্ভর নীতির পরিবর্তে আঞ্চলিক ভারসাম্যনীতি গ্রহণ করতে হবে। ট্রানজিট, পানি, সীমান্ত, বাণিজ্য প্রতিটি ক্ষেত্রে সমতা ও প্রতিদান-ভিত্তিক কূটনীতি প্রয়োগ করতে হবে, রক্ষিত শিল্পনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তাতে ভারতীয় পণ্যের অনুপ্রবেশ রোধ করার কৌশল হাতে নিতে হবে, নিরাপত্তা সংস্থা ও গণমাধ্যমে ভারতীয় প্রভাব খুঁজে নির্মূল করতে হবে এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নীতি ও শিক্ষানীতি সংস্কার করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের চাওয়া খুবই সীমিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, একটি সার্বভৌম ও জাতীয় স্বার্থকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি, ভারত বা অন্য কোন দেশের পুতুল নয়, নিজস্ব কণ্ঠে কথা বলা রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নির্বাচন, নীতিনির্ধারণ ও কূটনীতিতে কোনও বিদেশী প্রভু নয়, শুধু জনগণের ম্যান্ডেট থাকতে হবে এ টুকুই।
বিএনপি যদি নেতৃত্ব দিতে চায়, তাকে শুধু ক্ষমতার রাজনীতি নয়, স্বাধীনতার রাজনীতিতে ফিরতে হবে। বিএনপি যদি ২৪-এর বিপ্লবকে সত্যিকারে ধারণ করতে চায়, তাহলে ভারত-নির্ভর রাজনীতির বিপরীতে একটি নতুন ভিশন দিতে হবে, ‘সার্বভৌম বাংলাদেশ, নাগরিকের অধিকার রক্ষায় আপোষহীন’ রাষ্ট্রনীতির অঙ্গীকার। গণতন্ত্রে ভোটের চেয়ে বেশি জরুরি ভোটের পেছনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত। বিএনপি কি পারবে সেই স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করতে? পারবে কি ভারতীয় আগ্রাসনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার রাজনৈতিক দৃঢ়তা দেখাতে? এই প্রশ্নের জবাব যদি “হ্যাঁ” হয়, তবে জনগণ প্রস্তুত। এখন পালা বিএনপির শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার আদর্শে ফিরে আসার ও স্বাধিকার আন্দোলনের পুরোধা হয়ে ওঠার।