Saturday, April 26, 2025
No menu items!
spot_img
Homeবাংলাদেশরাষ্ট্র মেরামত/সংস্কার: দেশ গড়ার একটি নতুন বন্দোবস্ত - রাজা গোলাম রাব্বানী

রাষ্ট্র মেরামত/সংস্কার: দেশ গড়ার একটি নতুন বন্দোবস্ত – রাজা গোলাম রাব্বানী

আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্র মেরামতের অর্থ শুধুমাত্র সংস্কার নয়, এটি একটি পুনর্জন্ম। এদেশের প্রতিটি মানুষ যাতে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে, এবং রাষ্ট্রকে নিজের বন্ধু মনে করতে পারে— সেই স্বপ্নের জন্যই রাষ্ট্র মেরামতের প্রয়োজন। এটি একটি নতুন চুক্তির দাবি, যেখানে রাষ্ট্র আর শাসক নয়, জনগণেরই সেবক হবে।

আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই, ঢাকার রাজপথে শিশু-কিশোরেরা যখন প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “আমার ভাই মরলো কেন? আমরা নিরাপদ সড়ক চাই!”, তখন তারা কেবল সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবাদ করেনি; তারা প্রশ্ন তুলেছিল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও চরিত্রের উপর। সেদিন উঠে এসেছিল একটি ঐতিহাসিক স্লোগান: রাষ্ট্র মেরামত চাই। এই আহ্বান ছিল একটি ভেঙে পড়া রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক অনাড়ম্বর কিন্তু গভীর রাজনৈতিক উচ্চারণ। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে যখন “জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ” নামে একটি রাজনৈতিক রাজনৈতিক প্লাটফর্মের কাজ শুরু হয়, যারা পরবর্তীতে “আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) নামে আত্মপ্রকাশ করে তাড়া এই রাষ্ট্র মেরামতের ধারাটি সামনে নিয়ে আসে। আমার লেখায় “রাষ্ট্র মেরামত” ধারণাটির একটু গভীরে যাবো এবং তা কিভাবে একটি নতুন সামাজিক চুক্তির রূপরেখা দিতে পারে, তা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। যদিও এটা আমার একান্ত নিজের মতামত।

শুরুতেই আপনাদেরকে একটি প্রশ্ন করি রাষ্ট্র মানে শুধু সরকার? রাষ্ট্র মানে শুধু নির্বাচিত সরকার বা প্রশাসন নয়। রাষ্ট্র হলো নাগরিক, প্রতিষ্ঠান, আইন, মূল্যবোধ ও ইতিহাসের সম্মিলিত প্রকাশ। তাই রাষ্ট্র মেরামতের জন্য কেবল সরকারের পরিবর্তন যথেষ্ট নয়, যেখানে বেশী দরকার রাষ্ট্রচিন্তার পরিবর্তন, প্রশ্ন হলো এই রাষ্ট্রচিন্তা কে করবে? জনগণ, রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক নেতা নাকি সরকার? আমি মনে করি এই রাষ্ট্রচিন্তা রাষ্ট্রের জনগণ, রাজনৈতিক দল বা নেতা এবং সরকার সবাই মিলেই করবে এবং এই ত্রিপক্ষীয় চিন্তার ফসলই হলো একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। আর এই বন্দোবস্তের কাজটি করতে হয় সরকারের। সরকার কিভাবে এই কাজটি করবে সেই বিষয় একটু পরেই আলোচনা করবো।

জনগণ তাদের চাহিদা ও অধিকার প্রতিবাদ ও মতামত ব্যাক্তের মাধ্যমে তাদের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ২০১৯ ০ ২০১৪ সালের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন তার উৎকৃষ্ট উদাহারন। এরপর রাজনৈতিক দল ও নেতারা সেই চিন্তাকে দিকনির্দেশনা দেন, ভাষা দেন, নীতি বানান, এই ক্ষেত্রে তারা যদি জনবিচ্ছিন্ন হন, তাহলে রাষ্ট্রচিন্তা হয় ক্ষমতার হাতিয়ার, আর যদি জনমানুষের পাশে থাকেন, তাহলে তা হয় মুক্তির পথ। তাই সৎ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব রাষ্ট্রচিন্তা গঠনে অপরিহার্য। এরপর সরকার সেই রাষ্ট্র চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দেয়, নীতি ও আইনে রূপ দেয়। জনগণের আকাঙ্ক্ষা আর রাজনৈতিক আদর্শকে নীতিতে পরিণত করাই সরকারের কাজ কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন সরকার নিজেকে রাষ্ট্র মনে করে এবং জনগণকে “শাসনযোগ্য প্রজা” ভেবে বসে। তাই সবসময় রাষ্ট্রচিন্তা হবে সমন্বিত – জনগণ জন্ম দেবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিশা দেখাবে, আর সরকার বাস্তবায়ন করবে। সেখানে যদি একপক্ষও গাফিলতি করে, রাষ্ট্রচিন্তা হয়ে পড়ে বিকৃত, একচোখা বা নিছক ক্ষমতার কৌশল।

আমরা যদি একটু পিছনে ফিরে যাই, যে কথাটি আমি সব সময় বলি, ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছিল? মুক্তিযুদ্ধ ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবী ভোটাধিকার, অর্থনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের অনিবার্য রূপ। যে রূপ দিয়েছিল তৎকালীন রাজনৈতিক দল “আওয়ামীলীগ”, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী আওয়ামীলীগ সরকারের জনগণের চিন্তার সাথে গাদ্দারী ও স্বৈরাচারী একচোখা ও ক্ষমতার কৌশল জনগণের রাষ্ট্রচিন্তা বিকল হয়ে যায়, যা গত ৫৪ বছরে অনেক সরকারের পরিবর্তন হলেও কোণ সরকারই জনগণের রাষ্ট্র চিন্তা বাস্তবে রূপ দিতে পারে নাই। তাই ২৪ এর জুলাই বিপ্লবে আবারো ছাত্র জনতার দাবী প্রখর হয়ে ওঠে রাষ্ট্র সংস্কারের, প্রায় ২০০০ শহীদের রক্ত দিয়ে বিপ্লব সফল হয়। জনগণের দাবির সেই কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ডঃ ইউনুস সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আমি মনে করি বাংলাদেশের জনগণের জন্য এটা একটা মহা সুযোগ। এই সুযোগ যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে বাংলাদেশের জনগণ আবারো একটি দিক-নির্দেশনাহীন এক অনন্ত কালের দিকে যাত্রা করবে যা আমাদের নতুন ও অনাগত প্রজন্মের জন্য বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।

তাহলে আমরা জনগনের এই মুহূর্তে করনীয় কি? আমাদের (জনগণের) এই মুহূর্তে কিছু দাবী নিয়ে রাজপথে সংস্কার থাকা অত্যন্ত জরুরী, কারণ, আমাদের ২০২৪ জুলাই বিপ্লবের অর্জনকে নস্যাৎ করার জন্য এখনো দেশে বিদেশের চক্রান্ত থামে নাই। তাই জনতার সজাগ দৃষ্টি সংস্কারের প্রতি রাখা এখন প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। দাবীর মধ্যে প্রধান হলো রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার, তার মধ্যে আগামী নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক হয় সে জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা, বিচার ব্যাবস্থা যেন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত, স্বতন্ত্র বাজেট ও কার্যকর বিচার-প্রক্রিয়া নিশ্চিত হয় যেই কারণে বিচার ব্যাবস্থা সংস্কার। প্রশাসনে যাতে দলীয়করণ ও পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করে দক্ষ, জবাবদিহিমূলক সেবাকেন্দ্রিক সেই জন্য সংস্কার করে নতুন প্রশাসন গড়ে তোলা।দেশের জনগণ যাতে আইনি সেবা ও নিরাপত্তা পায় সেই জন্য দমনমূলক আইন বাতিল করে নিরাপত্তা বাহিনীর জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা।

দ্বিতীয়তঃ নৈতিক সংস্কার করে মনুষ্যত্বের ভিত্তি গড়ে তোলা। রাষ্ট্র মেরামত কেবল কাঠামোর নয়, চেতনার সংস্কারও বটে। দুর্নীতি, মিথ্যাচার, সুবিধাবাদিতা— এগুলো সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার ভাঙনই আজকের রাষ্ট্রচরম্পটের মূল কারণ। সেই কারণে নাগরিকদের জন্য নতুন নাগরিক শিক্ষা যেমন, নৈতিকতা, ইতিহাস, যুক্তিবাদ ও মানবিকতা কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা যাতে নাগরিকগণ রাজনৈতিক নেতা ও রাষ্ট্র নায়কদের বেআইনি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা, প্রতিবাদ ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলতে পারে।

তৃতীয়তঃ জনগণ-রাষ্ট্র সম্পর্কের পুনর্গঠনে একটি নতুন সামাজিক চুক্তি সম্পাদন করা যাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা আর জনগণের অধিকার যেন বিপরীতমুখী না হয়ে একটি সাম্য ও মানবিক রাষ্ট্র গ্রে ওঠে, যেখানে সম্পদের সুষম বণ্টন, সামাজিক সুরক্ষা, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়ত থাকবে, সকল ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ ও শ্রেণির জন্য সমান সুযোগ থাকবে, যেখানে মতপ্রকাশ, সমালোচনা ও প্রতিবাদকে গণতন্ত্রের অংশ হিসেবে মেনে নেওয়া হবে।

চতুর্থতঃ ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলেনে অংশগ্রহণকারী শিশু, কিশোর তরুণদের ভূমিকাকে সমুন্নত রেখে রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখার রূপকার হিসেবে রাষ্ট্র পুনর্গঠনে তরুণদের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্র গঠনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক চিন্তা ও নেতৃত্বে তরুণদের অংশগ্রহণ, ডিজিটাল নাগরিকতার বিকাশ, নতুন আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক জাগরণের নেতৃত্ব দেয়ায় উদ্বুদ্ধ করা।

পরিশেষে আমি আমার রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে বলতে চাই যে, এখন আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্র মেরামতের অর্থ শুধুমাত্র সংস্কার নয়, এটি একটি পুনর্জন্ম। এদেশের প্রতিটি মানুষ যাতে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে, এবং রাষ্ট্রকে নিজের বন্ধু মনে করতে পারে— সেই স্বপ্নের জন্যই রাষ্ট্র মেরামতের প্রয়োজন। এটি একটি নতুন চুক্তির দাবি, যেখানে রাষ্ট্র আর শাসক নয়, জনগণেরই সেবক হবে।

এখন সময়— কেবল বলার নয়, গড়ে তোলার। রাষ্ট্র মেরামত শুধু দাবী নয় এটি আমাদের একটি অপরিহার্য দাবিতে রূপান্তরিত করার সময়।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments