পুরো নাম জাস্টিন পিয়ের জেমস ট্রুডো। ১৯৭১ এর ২৫ ডিসেম্বর অটোয়াতে জন্ম। ৬ বছর বয়সে বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হলে ছোট দুই ভাইকে নিয়ে বাবার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেন জাস্টিন ট্রুডো। বাল্যকালের পুরোটাই কেটেছে প্রধানমন্ত্রী ভবন খ্যাত ২৪ সাসেক্স ড্রাইভে।
বয়স যখন ১২, তখন বাবা রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে মন্ট্রিয়লে বসবাস শুরু করলে Collège Jean-de-Brébeuf এ জাস্টিন ভর্তি হন। এরপর ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজনীতির আগে কিছুদিন সেকেন্ডারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন| একটি ভকেশনাল স্কুলেও ইনস্ট্রাটর হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তার|
২০০০ সালে বাবা পিয়েরে ট্রুডোর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় শোকসভায় এক বেদনাঘন ভাষণ দিয়ে দৃষ্টি কাড়েন জ্যেষ্ঠ পুত্র ২৯ বছর বয়সী জাস্টিন ট্রুডো। তার এই অসামান্য বক্তৃতাটি ‘কানাডার শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
জাস্টিন ২০০৭ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং বিভিন্ন ইভেন্টের এমসি এবং ফান্ড রেইজার হিসেবে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন। ২০০৮ সালে মন্ট্রিয়লের পাপিনো রাইডিংয়ে লিবারেল পার্টির মনোনয়ন নিয়ে প্রথমবারের মতো হাউজ অব কমন্সের ডেপুটি নির্বাচিত হন। একই আসন থেকে ২০১১-তে পুনঃনির্বাচিত হন। তবে এসময় তার দল এক ক্রান্তিলগ্ন পার করছিল। প্রথমবারের মতো হাউজ অব কমন্সে তৃতীয় স্থানে নেমে গিয়েছিল লিবারেল পার্টি। এমন এক পর্যায়ে ২০১৩ সালে লিবারেল পার্টির নেতা নির্বাচিত হন রাজনীতিতে অনেকটা আনকোরা জাস্টিন ট্রুডো।
অনেকটা আন্ডারডগ হিসেবে ২০১৫ সালের ফেডারেল নির্বাচনে লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব দেন। সেসময়ের এগিয়ে থাকা দল এনডিপি নেতা টমাস মিউলকেয়ারের একটি ভুল এবং তরুণ নির্বাচনী ক্যাম্পের সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণার সাফল্যে জাস্টিন ট্রুডো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। নির্বাচনের পরবর্তী ভোরে মন্ট্রিয়েলের কয়েকটি মেট্রো স্টেশনে জনগণের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় তার জনপ্রিয়তাকে নিয়ে যায় অন্যরকম উচ্চতায়। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দিবসে তার বিশেষভাবে শুভেচ্ছাবাণী উপস্থাপন, ইফতারের সময়, ঈদের অনুষ্ঠান কিংবা পূজাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া, প্রাইড প্যারেডে একাত্মতা এসব কাজ জনগণের সাথে সম্পৃক্ত রাখে।
মন্ত্রী হিসেবে কোনো মন্ত্রণালয় চালানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না ট্রুডোর। এক ঝাঁক নতুন লোক নিয়ে গঠন করেন মন্ত্রিসভা যাদের বেশিরভাগের ছিল না বলার মতো কোনো অভিজ্ঞতা। ফলে বলার মতো তেমন কিছুই চোখে পড়েনি তার প্রথম মেয়াদের শাসনামলে। কানাডিয়ানরা সাধারণত তাদের নেতাদের দুই টার্ম সুযোগ দিতে চান। সেইসাথে বিপক্ষ কনসারভেটিভ শিবিরে তেমন কোনো ক্যারিশমেটিক নেতা ছিল না। ফলে লিবারেল পার্টি এবং জাস্টিন ট্রুডোকে নিয়ে এসএনসি লাভালিনের কেলেঙ্কারিসহ নানা সমালোচনা সত্ত্বেও ২০১৯ সালে জনগণ আরও এক মেয়াদের জন্য ট্রুডোর হাতেই কানাডার শাসনভার ন্যস্ত করে।২য় মেয়াদে অবশ্য নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। এনডিপি’র সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন জাস্টিন ট্রুডো।
২০২০/২০২১ সালে করোনাকালীন সময়ে নাগরিকদের জন্য ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স বেনিফিট’ নামে নতুন একটি সহায়তা কর্মসূচি চালু করে বেশ জনপ্রিয় হন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন। প্রায় প্রতিদিন মিডিয়াতে এসে আতঙ্কিত জনগণকে আশ্বস্ত করেন জাস্টিন। এক এক দিন এক এক বেনিফিটের ঘোষণা দেন ট্রুডো।
এই সময় তার জনপ্রিয়তা কিছুটা বৃদ্ধি পায়। এনডিপির উপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে ২০২১ সালে পার্লামেন্ট ভেঙে নতুন নির্বাচন ঘোষণা করেন। আশা করেছিলেন যে করোনাকালীন সহায়তা এবং দুর্যোগকালীন সময়ে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে জনগণ তাকে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী করবে। ট্রুডোর সে আশা পূরণ হয়নি। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন, তবে ২য় বারের চেয়ে কম আসন পেয়ে। ক্ষমতাকে দুই বছর বাড়াতে গিয়ে একেবারে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন জাস্টিন ট্রুডো।
অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে পর্যটক নিয়ে আসেন, যা উল্টো কানাডার অর্থনীতিতে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সেই সাথে আন্তর্জাতিক ছাত্র হিসেবে যারা কানাডায় পড়াশোনা করছিল, তাদের অভিবাসন কঠিন হয়ে পড়ে। ট্রুডোর এই উল্টো পথে যাত্রা কানাডার অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তার সরকারের নেওয়া ভুল অর্থনৈতিক নীতির কারণে আবাসন সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। বাসা-বাড়ি ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আবাসনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেন ট্রুডো। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
মুদ্রাস্ফীতিতে কানাডিয়ানদের জীবন অতিষ্ট হয়ে পড়ে| ঋণ বাড়তে থাকে, ফুড ব্যাংকের উপর নির্ভরতা বেড়ে যায়| কার্বন ট্যাক্স, ইউক্রেন, LGBT+ সহ বিভিন্ন ইস্যুতে তার জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামে| প্রধান বিরোধী দল কনসারভেটিভের চাপে ক্রমশ কোনঠাসা হয়ে পড়েন| এক পর্যায়ে তাকে টিকিয়ে রাখা NDP’ র সমর্থন হারান ট্রুডো| নিজ দলে যাদেরকে তুলে নিয়ে এসেছেন ট্রুডো, তারাও তাকে পদত্যাগের জন্য ক্রমশ: চাপ দিতে থাকে| এমতাবস্থায় দলীয় নেতৃত্ব এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেয়া ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তা ছিলোনা প্রধানমন্ত্রীর।
জাস্টিন ট্রুডো ভবিষ্যতে কোনো এক দিন কানাডার রাজনীতিতে কাম-ব্যাক করবেন, সে সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীন| এমন এক সময় কানাডার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন যখন অভিবাসীদের মাঝে ২য় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হওয়ার আতঙ্ক ভর করেছিল| নয় বছরের শাসনামলে হীনমন্যতায় ভোগা অভিবাসীদের এ বিষয়ে নির্ভার রাখতে পেরেছেন ট্রুডো| সামগ্রিক সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলেও কানাডায় ইমিগ্রেন্টদের জন্য তিনি অনেক কিছু| সুদর্শন, মিষ্ঠভাষী, মিশুক এবং বন্ধু বৎসল নেতা হিসেবে তার লিগেসি বেঁচে থাকবে অনেক দিন|
লেখকঃ শিহাব উদ্দীন, কানাডা