নিউজ ডেস্কঃ গত কয়েক বছর থেকে মার্চ-এপ্রিল থেকে ভারত থেকে আসা উজানের ঢলে তলিয়ে যাচ্ছে সিলেট, সুনামগঞ্জ সহ বিভিন্ন হাওর অঞ্চলের লক্ষাধিক হেক্টর জমির ফসল। একই কারনে সিলেট সহ তলিয়ে গেছে দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা। ফসল হারিয়ে পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে কোটি মানুষ। প্রতি বছর এই মৌসুমে, সাধারনতঃ মার্চ থেকে অক্টোবর মাসে, একই কারনে সুনির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের কোটি কোটি সাধারন মানুষকে এই মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য করছে এই ভঙ্গুর নতজানু রাষ্ট্র তার অকার্যকর নীতি ও কৌশলের কারনে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন ৫৪ টি নদী আছে। গঙ্গা নদীতে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে রেখেছে ১৯৭৪ সাল থেকে, তিস্তা ব্যারেজ দিয়ে পানি আটকে রেখে উত্তরবঙ্গের কৃষি সম্ভাবনাকে গলাটিপে মারার চেষ্টা চলমান। অন্যদিকে, ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার করে ত্রিপুরায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫১ বছরেও পানি বন্টন ইস্যুর কোন সমাধান সম্ভব হয় নাই।
কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার কথা বলে ভারত পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কায় গঙ্গার ওপর বাঁধ দেয়, যা চালু করা হয় ১৯৭৫ সালে, প্রথম বাকশালের আমলে। এর ফলে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের ভেতরে পদ্মায় পানি কমে আসে আবার বর্ষা মৌসুমে দেখা যায় উল্টো চিত্র তখন ভারতের উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশে ঢুকে তৈরি হয় বন্যা। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল শুষ্ক মৌসুমে প্রতি বছর ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১শে মে পর্যন্ত ১০ দিনের চক্র করে দুই দেশ পানি ন্যায্যভাবে ভাগ করে নেবে। কিন্তু, এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের উপকার যা হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে বেশি। নদীকে ঘিরে পেশা ছিল এমন মানুষেরা গ্রামকে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছেন, ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে, লক্ষাধিক কোটি টাকার সম্পদ বিলীন হয়ে গেছে। এক সময় পদ্মার নদীপথে অসংখ্য ছোটবড় জাহাজ এবং মাছ ধরার নৌকা দিনরাত চলতো কিন্তু এখন শুষ্ক মৌসুমে প্রায় সাড়ে তিনশো’ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ বন্ধ রাখতে হয়।
সিকিম থেকে উৎপত্তি হয়ে তিস্তা নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে৷ ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে এর পানি প্রবাহ এক হাজার কিউসেকেরও নিচে নেমে যায়৷ ১৯৮৭ সালের পর থেকে তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের সাথে কোনো চুক্তি নেই বাংলাদেশের৷ একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত৷ ফলে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় পানিসংকট চলছে৷ ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরে তিস্তা পানি চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিরও তখন ঢাকা আসার কথা ছিল৷ কিন্তু মমতা শেষ পর্যন্ত আসেননি, তিস্তা চুক্তিও হয়নি৷ ২০১৫ সালে মমতা একাই ঢাকায় এসেছিলেন৷ আর ঢাকায় বসেই তিনি তিস্তার পানি দেয়া যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন৷ তার কথা, তিস্তায় দেয়ার মতো পানি নেই৷
ভারতের আইন অনুযায়ী, কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিলেই হবে না, রাজ্যের অনুমোদন লাগবে৷ রাজ্যের কৃষকদের সেচের স্বার্থে তিস্তার জল বাংলাদেশকে দেওয়া সম্ভব হবে না৷ অথচ, দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প, তিস্তা সেচ প্রকল্প এই অঞ্চলেই অবস্থিত৷ উত্তরাঞ্চলজুড়ে থাকা এই প্রকল্পে এখন মাঝেমাঝেই পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। যদিও সরকার তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আগ্রহী, কিন্তু চীনা অর্থায়নে এ প্রকল্প ভারতের বিরোধিতায় কতটুকু এগুবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
এদিকে, ২০১৯ সালের ৫ই অক্টোবর, একটি সমঝোতা স্মারকের আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত৷ বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাতে সম্মতি দিয়েছিল। ওই পানি তারা ত্রিপুরা সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে। অবশ্য ২০০২ সাল থেকেই পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছিল ভারত কোন রকম চুক্তি ছাড়াই। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কুশিয়ারা নদীতে একটি সেচ প্রকল্পের জন্য ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলনের জন্য খাল সংযোগের ব্যাপারে ভারতকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার তাগাদা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। অথচ, সে বিষয়ে আর এগুনোই গেল না। ১৯৭২ সালের মার্চে যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়েছিলো দু দেশের প্রধানমন্ত্রীদের এক যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে।কিন্তু ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হলেও অভিন্ন বাকী নদী গুলোর পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি।
গত কয়েক বছরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার মধ্যেই ২০১৯ সালে আলোচনায় আসে ছয়টি নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি। এই নদীগুলো হচ্ছে- মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার। এই ছয়টি নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে, চুক্তি হলেও যে বাস্তব লাভ হবে না সেটা গঙ্গা চুক্তিতে প্রমাণিত হয়েছে। বাস্তবতা হল, পানির দাবি আদায় করতে রাজনৈতিক ভাবে ব্যর্থ হয়েছে সকল সরকার। চুক্তি নয় বরং প্রথমত যেটা নিশ্চিত করা দরকার ছিল, তা হল সমতাভিত্তিক সম্পর্ক যা স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই করা হয়নি। নতজানু পরারাষ্ট্রনীতি, কূটনৈতিক অদক্ষতা, তথ্য ও গবেষণার অভাবে সরকার বারবার নদীর ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে করে এবি পার্টি। আসন্ন দিল্লী সফরে তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে প্রস্তাবিত চুক্তি এবং ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ নতুন করে আলোচনায় উঠে এলেও বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোনও মন্ত্রী বা আমলা দিল্লিতে যাচ্ছে না। দখলদার ও অনির্বাচিতদের সাথে কোন রাষ্ট্র ন্যায্যতার সম্পর্ক রাখে না, সেই সম্পর্ক হচ্ছে গোলামীর।
সূত্রঃ আমার বাংলাদেশ পার্টির ফেসবুক পেজ থেকে