মেহেদী হাসান পলাশঃ বাংলাদেশের সেরা ৫ জন কবির মধ্যে আল মাহমুদ অন্যতম এবং স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সেরা কবি নিঃসন্দেহে। চিন্তা, সৃজন ও মননের জগতে যে বন্ধ্যা, অনুর্বর সময় আমরা পার করছি তাতে আরেকজন আল মাহমুদ বাংলা ভাষায় জন্মাতে কত শত বছর লাগবে আমি জানি না। কিন্তু সেই কবির মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও নাগরিক প্রতিক্রিয়া দেখে আমি মর্মাহত, ব্যথিত। সকালে পত্রিকা খুলে, টিভির স্ক্রলে চোখ বুলিয়ে আল মাহমুদের মৃত্যুতে সরকারী শোক বাণী খুঁজলাম, পেলাম না।
আল মাহমুদ একদা জাসদ করতেন, বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাসাসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, এরশাদ ঘেঁষা ছিলেন, এমনকি শেষ জীবনে যাদের সমর্থন করার কারণে অনেকেই আল মাহমুদকে বিতর্কিত বলেন সেই জামায়াত- কারো বিবৃতিই চোখে পড়েনি। জামায়াতের মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রামে আল মাহমুদের মৃত্যুর সংবাদই ছাপেনি। আল মাহমুদের একটি কবিতা, লেখা না হলে যেসব পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা মর্যাদা পেতো না সেসব পত্রিকায় আল মাহমুদের মৃত্যু সংবাদের ট্রিটমেন্ট দেখে কষ্টভরা দীর্ঘশ্বাস পড়েছে।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে প্রেসক্লাবে আল মাহমুদের জানাযায় অংশ নিতে গেলাম। সেখানে গিয়ে আরো মন বিষিয়ে উঠল। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত, জনপ্রিয় ও বিপ্লবী পত্রিকা জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠের সম্পাদক ছিলেন আল মাহমুদ। এ পত্রিকা সম্পাদনার দায়ে জেল খেটেছেন তিনি। কিন্তু তার কফিনের পাশে জাসদ সমর্থক কোনো সাংবাদিককে দেখলাম না। একটি বিশেষ ধারার করগণ্য কিছু সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতাদের দেখলাম। প্রেসক্লাবের, কিম্বা অন্যধারার সাংবাদিক নেতাদেরও দেখিনি। প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ বিএনপির পক্ষ থেকে পুস্পস্তবক অপর্ন করেছেন, সাথে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আহমদ আজম খান। বিএনপির কোনো সিনিয়র নেতা নেই্। জাসাস নেতৃবৃন্দকে দেখলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, বিবৃতি নেই কেন? জানালো, আজ দেয়া হয়েছে। আজ হয়তো আরো অনেকেই দেবে বা দিয়েছে। কিন্তু আল মাহমুদ হাজির না হলে যেসব সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভা অলঙ্কৃত হতো না, পৌরহিত্য হতো না- তাদের কাউকেই দেখলাম না।
আল মাহমুদ ভাষা সৈনিক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার অপরাধে পুলিশের তাড়া খেয়ে ঢাকা শহরে সেই যে এসেছিলেন, তারপর স্থায়ী হয়েছিলেন। প্রেসক্লাবে ঢাবি শিক্ষক ড. মামুনের কাছে শুনলাম, শহীদ মিনারে তার লাশ নেয়ার অনুমতি দেয়নি ঢাবি কর্তৃপক্ষ। কবি আবদুল হাই শিকদার ভাইয়ের কাছে শুনলাম, বাংলা একাডেমিতে তার লাশ নেয়া হলেও সেখানে কোনো জানাযার ব্যবস্থা করা হয়নি। আল মাহমুদ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন একথা কেউই অস্বীকার করে না। সব থেকে দুঃখজনক বিষয় শুনলাম, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রাপ্য গার্ড অভ অনারটুকু তাকে দেয়া হয়নি। একজন মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানী হানাদারদের অধীনে চাকরী করে বেতন নিয়েও লিখলেন, ‘তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা সিঁথির সিঁদুর মুছে গেলো মুছে গেলো হরিদাসীর। তিনি হলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিশান বরদার। আরেকজন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে লিখলেন, ‘আমাদের আজানই তো আমাদের স্বাধীনতা›। তাই তিনি হলেন রাজাকার। কোলকাতা থেকে যাদের কারণে বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হলো আল মাহমুদ তাদের পুরোধা। সেই ঢাকার বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে কবির জন্য সাড়ে তিন হাত জায়গা বরাদ্দ হলো না। মাহমুদ ভাইয়ের পরিবারের ইচ্ছা ছিলো জাতীয় ঈদগাহে জানাযা করার, কাজী নজরুল ইসলামের কররের পাশে কবর দেয়ার- কিন্তু সেসব ইচ্ছে পুরণ হয়নি।
মাহমুদ ভাই, এই অর্থগৃন্ধু সমাজ, বিভেদ মথিত, পরজীবী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ সমাজ আপনার লাশের সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছে সেটা এই সমাজের লজ্জা। মাহমুদ ভাই, অভিমান করবেন না। আপনি আমাদের ক্ষমা করুন। আপনি জানেন, ‘আল মাহমুদ মানেই আদি অন্তহীন আজন্ম মিছিলের অনিবার্যতা›। আপনি তো বলেছিলেন, আপনার ‘যাত্রা অনন্ত কালের›। ‘উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আপনাকে কোনো দিনই বিহবল করতে পারেনি›। মাহমুদ ভাই আপনি চেয়েছিলেন, কোনো ‘শুভ শুক্রবারে› আল্লাহর দূত আপনার কাছে আসুক। আল্লাহ আপনার কথা শুনেছেন। শুভ শুক্রবারেই আল্লাহ তার দূত পাঠিয়ে আপনাকে তার ‘সিংহাসনের নিচে› নিয়ে গেছেন। এ যে অসামান্য। আপনি পরাজিত হননি। আপনার গন্তব্যতো ‘এক সোনার তোরণের দিকে›। আপনি পৌঁছুতে চেয়েছিলেন,
‘প্রভূ তোমার সান্নিধ্যে’।
‘এই ভূ-পৃষ্ঠে নেই› এমন ‘সোনার তোরণ পেরিয়ে› সেই গন্তব্যে আপনি পৌঁছে গেছেন।
সেই মহাপ্রভুর ‘সিংহাসনের নীচে একটি ফুরফুরে প্রজাপতি হয়ে›। ভাল থাকুন মাহমুদ ভাই অনন্তকাল।
সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব